বৌদ্ধ ধর্মের আত্মাবাদ ও অনাত্মাবাদ কি ?
আত্মাবাদ এবং অনাত্মাবাদ বৌদ্ধ ধর্মে একটি দুর্বোধ্য এবং জটিল একটি বিষয়। পৃথিবীতে সকল ধর্মই এ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান এবং ধর্মের বিশ্লেষণ অনুসারে মত প্রকাশ করেছেন। আবার অনেক বৌদ্ধ বলেন, না, বুদ্ধ বলেছেন “সাব্বে ধাম্মা আনাত্তা” তার মানে আত্মাবাদ নয়, বৌদ্ধ ধর্ম অনাত্মাবাদ ধর্ম। আসলেই কি ব্যাপারগুলো এত সহজ! নাকি এর মধ্যে বুদ্ধ অন্য কিছু নির্দেশ করেছেন। চলুন! আজ আমরা জানব সে বিষয়ে- আত্মাবাদ এবং অনাত্মাবাদঃ বৌদ্ধ ধর্মে স্থান কোনটি ? আমরা জানি যে, বুদ্ধ জম্বুদ্বীপে আবির্ভূত হবার আগে ২ টি ধর্মীয় মতবিশ্বাস প্রচলিত ছিল। সেগুলো হল-
১। ব্রাহ্মণবাদ
২। শ্রামণবাদ
প্রথমেই ব্রাহ্মণবাদ আত্মা বিষয়ে কি বলতে চাইছেন একটু আলোচনা করা যাক। প্রাচীনকাল থেকে ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় গ্রন্থ রিগবেদ অনুসারে দুই ধরণের আত্মা বিদ্যমান। সেগুলো হল-
১। জগত আত্মা
২। ব্যক্তিগত আত্মা
ব্যক্তিগত আত্মা হল প্রত্যেক সত্তার ভেতরে অবস্থানরত আত্মা। প্রত্যেকেই কোন না কোন আত্মা দ্বারা পরিচালিত। ব্যক্তি যা কিছু করে তা আত্মার মাধ্যমে করে। এইসব আত্মার নেই কোন শুরু বা শেষ। সত্তা যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন আত্মা অন্য নতুন এক দেহে প্রবেশ করে, ঠিক আমরা যেমন কাপড় নোংরা হবার পর সেটি ফেলে নতুন পোশাক পড়ি। কারণ এ আত্মা আমাদের শরীরের ভেতরে বন্দী। যখন সাধনা করার পর ব্রহ্মলোকে উত্তীর্ণ হওয়া যায় তখন আত্মাটি জগত আত্মার সাথে মিলিত হয়। সাধনার এ উত্তীর্ণ হওয়াকে বলে মোক্ষ। জগত আত্মা হল যেসব ব্যক্তিগত আত্মা মোক্ষ লাভ করে সব এক স্থানে মিলিত হয়, সেই স্থানকে বলা হয় জগত আত্মা। এই আত্মা শাশ্বত ভাবে আত্মাগুলোকে ধারণ করে। তবুও আত্মাগুলোর ধ্বংস নেই।
ব্রাহ্মণবাদের পরে জম্বুদ্বীপে আরেক মতবাদের উদ্ভব হয় যেটা হল শ্রামণবাদ। শ্রামণবাদ মতালম্বিরা ব্রাহ্মণবাদের বিরোধী। বেশিরভাগ শ্রামণ এসেছেন ক্ষত্রিয় বংশ থেকে। কারণ আমরা জানি যে, তৎকালীন ভারতীয় সমাজে চারটি বর্ণ ছিল যা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা বেশি ছিল। কারণ তারা জন্মগত ভাবে ব্রাহ্মণ এবং এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে ব্রাহ্মণরা ব্রহ্মার মুখ থেকে সৃষ্টি হয়েছেন। এসব সামাজিক বৈষম্যর বিরোধিতা করে শ্রামণরা ভিক্ষা লব্ধ জীবিকার মাধ্যমে নতুন মতবাদ প্রচার করে ঠিক ব্রাহ্মণবাদের বিপরীত। তাদের মধ্যে একটি বিষয় হল অনাত্মাবাদ। তাদের মতে, সত্তার ভেতরে কোন আত্মা নেই। সত্তা শুধুমাত্র চারটি ধাতু দিয়ে গঠিত , সেগুলো হল- পৃথিবী, তেজ, বায়ু ও জল। মৃত্যুর পর পৃথিবী ধাতু পৃথিবীতে, তেজ ধাতু তেজে, বায়ু ধাতু বায়ুতে এবং জল ধাতু জলে গমন করে।
এর পর ৬২৩ অব্দে জম্বুদ্বীপে (বর্তমান নেপালে) মহামানব সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। ৩৫ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধ হিসেবে পরিচিত হন এবং প্রথম ধর্মদেশনা করেন ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র, যার মাধ্যমে জগতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় সূত্র হল অনাত্ম লক্ষণ সূত্র। এ সূত্রে বুদ্ধ যে ব্রাহ্মণবাদের আত্মাকে অস্বীকার করেছিলেন, এটা সত্যি। কিন্তু অনাত্ম লক্ষণ সূত্র বলে বুদ্ধ যে অনাত্মকে সমর্থন করেছেন, এটা কিন্তু পরিষ্কার নয়। তা হলে শ্রামণবাদদের মতবাদ সত্য এবং যুক্তিসঙ্গত ছিল। জগতে বুদ্ধ আবির্ভূত হবার প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া বুদ্ধ দুইটি মতবাদের উপরে।
১/ শাশ্বতবাদ বা চিরস্থায়ী
২/ নাস্তিবাদ বা উচ্ছেদবাদ
এ প্রসঙ্গে বচ্ছগোত্র সূত্র টেনে আনা প্রয়োজন। এ সূত্রে বচ্ছগোত্র নামক জৈনিক ব্যক্তি বুদ্ধকে একদিন প্রশ্ন করেছিলেন যে “হে বুদ্ধ ভগবান, আত্মা বলে কি কিছু আছে? বুদ্ধ নীরব ছিলেন।বচ্ছগোত্র আবার প্রশ্ন করল, “তাহলে আত্মা বলতে কি কিছুই নেই”। এ প্রশ্নেও বুদ্ধ নীরব ছিলেন। এর পর বচ্ছগোত্র প্রস্থান করল। তখন বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ এসে বুদ্ধকে নীরব থাকার বিষয়টি জানতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে বুদ্ধ বললেন আমি যদি প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সম্মতি দিতাম তাহলে সেটা হত শাশ্বতবাদ বা চিরস্থায়ী, যদি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে সম্মতি দিতাম তাহলে সেটা হত নাস্তিবাদ বা উচ্ছেদবাদ।
বুদ্ধ নীরব থাকার অর্থ হল বুদ্ধ হ্যাঁ বা না কোনটিকেই সমর্থন করেন নি। বুদ্ধ সমর্থন করেছেন প্রতীতসমুদপাদ নীতিকে। যেখানে সবকিছুর সৃষ্টি, পরিবর্তন এবং ধ্বংস হয়। যা কিছু সৃষ্টি হয় সেখানে নেই বলার জো নেই। তার মানে উচ্ছেদবাদ এখানে মিথ্যা। আর যা কিছু ধ্বংস হয় সেখানে আছে বলার জো নেই। তার মানে শাশ্বতবাদ এখানে মিথ্যা। বুদ্ধের মতে সবকিছুর সৃষ্টি, পরিবর্তন এবং ধ্বংস আছে। তাই আছে না নেই কোনটিই এখানে সঠিক নয়। কারণ আমাদের মন ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছে। ঠিক যেমন একটি শিশু ধীরে ধীরে বড় হতে হতে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত পরিবর্তিত হন। আমাদের মন আমাদের চোখের পলক ফেলার চাইতেও দ্রুত গতিতে পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের ভেতরে এমন কিছু আছে যেটা ডট এর মত, ......... এ ধরনের। ডট এর মাঝখানে ফাঁক দেখতে পাচ্ছি আমরা। ডট হল উৎপত্তি, ফাঁক হল ধ্বংস। এভাবে চলতে থাকবে যতদিন কেউ নির্বাণ সাক্ষাৎ করতে পারবে না।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন যদি আত্মা নাই বা থাকে তাহলে কিভাবে পুনর্জন্ম হয়। এভাবে চলমান সৃষ্টি, পরিবর্তন এবং ধ্বংস মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত চলে। যখন সত্তা মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে চলে আসে, সেই মুহূর্তে তার পুনর্জন্মে সত্তার অতীত অতীত কর্ম বিপাক (ভালো বা খারাপ) তাকে নতুন জন্মের জন্য নির্ধারণ করে। আচার্য বুদ্ধঘোষ ভান্তের ভাষায় এ নতুন জন্ম নির্ধারণ কে বলা হয় প্রতিসন্ধি বিজ্ঞান।
অতএব বৌদ্ধ ধর্মে আত্মাবাদ বা অনাত্মাবাদ দুইটিকে ভুল হিসেবে বলা হয়। তবুও আত্মাবাদ এবং অনাত্মাবাদ এ দুটি শব্দ থেকে বুদ্ধকে অনাত্মাবাদ শব্দটি নিতে হয়েছিল শুধুমাত্র বোঝার খাতিরে। কারণ বুদ্ধের জ্ঞানের তুলনায় আমাদের ভাষা অত্যন্ত স্বল্প। আমাদের ভাষা তৈরি শুধুমাত্র আমাদের ষড়আয়তনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। কিন্তু বুদ্ধের ধর্ম তার চেয়েও অধিক দূরে গমন করে। তার ভাষা অত্যন্ত সংকীর্ণ। কারণ আত্মাবাদ বা অনাত্মাবাদ এর মাঝখানে কি বলা যেতে পারে সেটা সাধারণ ভাষায় নেই। তাই বোঝার খাতিরে বলা হয় সাব্বে ধাম্মা আনাত্তা। কিন্তু বস্তুতপক্ষে সেটি হবে সৃষ্টি, পরিবর্তন এবং ধ্বংস।
তথ্যসূত্র-
Samyutta Nikaya- Translated By the Bhikkhu Bodhi
What the Buddha Taught-Ven. Walpola Rahula
What Buddhist Believe- Ven. K.Sri Dhammananda
Collected Lecture from Prof. Dr. Kapila Abhayawansa at International Buddhist College